জাতীয়

মা ইলিশের অভয়ারণ্যে টাকার খেলা: নৌ-পুলিশের ঘুষের বিনিময়ে রাতে অবৈধ শিকার, অভিযান প্রহসনে পরিণত

মা ইলিশের অভয়ারণ্যে টাকার খেলা: নৌ-পুলিশের ঘুষের বিনিময়ে রাতে অবৈধ শিকার, অভিযান প্রহসনে পরিণত

সরকারি নিষেধাজ্ঞা চলাকালেও শরীয়তপুরের পদ্মা ও মেঘনা নদীতে চলছে অবৈধভাবে মা ইলিশ শিকার। মা ইলিশের প্রজনন রক্ষায় সরকারের বিশেষ অভিযান চলাকালীনই নৌ-পুলিশের কতিপয় অসাধু সদস্যের বিরুদ্ধে ঘুষ বাণিজ্যের গুরুতর অভিযোগ উঠেছে। অভিযোগ, রাতে মোটা অংকের টাকার বিনিময়ে তারা নদীতে মাছ ধরার সুযোগ দিচ্ছেন, যার ফলে প্রশ্ন উঠেছে— সরকার পরিচালিত এই বিশেষ অভিযান "মা ইলিশ সংরক্ষণ" আসলে কতটা কার্যকর হচ্ছে।

জেলা মৎস্য বিভাগ সূত্র অনুযায়ী, সরকার ৪ অক্টোবর থেকে ২৫ অক্টোবর পর্যন্ত ২২ দিন মা-ইলিশের ডিম ছাড়ার জন্য নদীতে আসার সময়ে মাছ শিকার নিষিদ্ধ করেছে। কিন্তু অভিযোগ রয়েছে, দিনের বেলায় অভিযান কঠোর হলেও, রাতের আঁধারে জেলার প্রায় ৩০টি পয়েন্টে নিয়মিত প্রকাশ্যে কারেন্ট জাল দিয়ে অবাধে মা ইলিশ শিকার করা হচ্ছে।

 

রাত হলে অরক্ষিত নদী, চলছে টাকার খেলা

 

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, শরীয়তপুরের জাজিরা, নড়িয়া, ভেদরগঞ্জ ও গোসাইরহাট উপজেলার প্রায় ৩০টি পয়েন্টে শত-শত জেলে মাছ শিকার করে। প্রতিদিন রাত হলেই নদী যেন অরক্ষিত হয়ে ওঠে। জেলেরা নদীর তীরের গ্রামগুলোতে হাট বসিয়ে দেদারসে বিক্রি করছেন এসব ইলিশ।

স্থানীয় জেলেদের অভিযোগ, রাতে নদীতে টহলের নামে কিছু পুলিশ সদস্য জেলেদের কাছ থেকে ঘুষ নিয়ে মাছ ধরার সুযোগ করে দিচ্ছেন। দিনে জাল জব্দ ও আটক জেলেদের ছবি তুলেই থেমে যাচ্ছে অভিযান, আর রাতে শুরু হচ্ছে টাকার খেলা

কাঁচিকাটা এলাকার জেলে সজিব হোসেনের ভাষ্য, "রাতে নৌপুলিশের লোকজনের সাথেই কিছু জেলে নদীতে নামে। তারা আগেই টাকা দিয়ে রাখে। দিনে অভিযান হয়, রাতে নদীতে মাছ ধরা চলে পুরোদমে।" তিনি আরও অভিযোগ করেন, ম্যাজিস্ট্রেট বা মৎস্য কর্মকর্তা নদীতে নামলে নৌপুলিশ আড়তদারদের আগেই খবর দিয়ে দেয়।

 

নৌকা প্রতি ঘুষ ১০ থেকে ১৫ হাজার টাকা

 

জেলেদের অভিযোগ আরও স্পষ্ট। কোদালপুর লঞ্চঘাট এলাকার জেলে কাশেম ভূইয়ার মতে, "আমাদের প্রতি নৌকায় দশ থেকে পনেরো হাজার টাকা পর্যন্ত ঘুষ দিতে হয় নৌপুলিশকে, যা পুরো অভিযানের জন্য আদায় করা হয়।" এমনকি কোথায় কখন অভিযান হবে, সে তথ্যও আগেই জানিয়ে দেয়া হয় বলে অভিযোগ করেন তিনি।

জাজিরা বাবুরচর এলাকার জেলে ইয়াকুব আলী বলেন, প্রতিদিন মাঝির ঘাট ও সুরেশ্বর ফাঁড়ীকে নৌকা প্রতি ৩০০ টাকা দিতে হয়। তার পাঁচটি নৌকা রয়েছে, এতে প্রতিদিন রাতে নৌপুলিশকে ১৫০০ টাকা দিতে হয়। তিনি জানান, টাকা না দিলে নৌপুলিশ ধরে নিয়ে যায় এবং পরে মোটা অংকের ঘুষ নিয়ে ছেড়ে দেয়।

আড়তদার গফুর বেপারি এই অভিযানকে 'প্রহসন' আখ্যায়িত করে বলেন, "কিছু পুলিশ আর দালাল মিলেই নদীতে টাকার বিনিময়ে মাছ ধরার সুযোগ দিচ্ছে। বেশিরভাগ আড়তদার নৌপুলিশের সাথে যোগাযোগ করে নদীতে জেলেদের ইলিশ শিকারে পাঠায়।"

 

প্রশাসনের বক্তব্য ও নীরবতা

 

এদিকে টাকা নেওয়ার অভিযোগ অস্বীকার করেছেন নৌপুলিশের সুরেশ্বর ফাঁড়ির দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা। তিনি বলেন, "আমরা নিয়ম অনুযায়ী কাজ করছি। কেউ যদি আমাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ করেন প্রমাণ থাকলে তদন্ত হবে।" তবে মাঝির ঘাট নৌপুলিশের কর্মকর্তা এবিষয়ে কথা বলতে রাজি হননি।

জেলা মৎস্য কর্মকর্তা বিশ্বজিৎ কুমার দেব বলেন, "মা ইলিশ রক্ষায় নিয়মিত আমাদের অভিযান অব্যাহত রয়েছে। কেউ অভিযানের নামে অনিয়মে জড়িত থাকলে তদন্ত সাপেক্ষে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে।