২০২৪ সালের আগস্টে বাংলাদেশে সৃষ্ট ছাত্র-জনতার রক্তাক্ত অভ্যুত্থানের পটভূমিতে, আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের মাধ্যমে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত করার ঘটনাটি বিশ্ব রাজনীতি ও বিচার ব্যবস্থার ইতিহাসে এক বিরল দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে। অভিযোগ ছিল, প্রধানমন্ত্রী হিসাবে তিনি নিরাপত্তা বাহিনীর ওপর নিয়ন্ত্রণ রাখতে ব্যর্থ হন এবং বহুক্ষেত্রে সহিংসতা উসকে দেন, যার ফলে হাজারো মানুষের হতাহতের ঘটনা ঘটে। এই রায়কে অন্তর্বর্তী সরকার সত্য ও ন্যায়বিচারের প্রতীক হিসাবে তুলে ধরলেও, শেখ হাসিনা দিল্লি থেকে এটিকে সম্পূর্ণ রাজনৈতিক প্রতিহিংসা এবং পক্ষপাতদুষ্ট বিচার বলে আখ্যা দিয়েছেন।
এই পরিস্থিতিতে, ভারতের কাছে শেখ হাসিনাকে হস্তান্তর করার বিষয়টি এখন অভ্যন্তরীণ ও আন্তর্জাতিক বিতর্কের জন্ম দিয়েছে। একদিকে, বাংলাদেশের জনগণের বড় একটি অংশ মনে করে, হাজারো নিরপরাধ মানুষের প্রাণহানির জন্য দায়ী নেত্রীর বিচার ও দণ্ড কার্যকর করা ন্যায়বিচারের পূর্ণতা দেবে। তাই তারা ভারতের কাছে তাকে দ্রুত হস্তান্তরের দাবি জানাচ্ছে। এই দাবি এক অর্থে, ইতিহাসেও প্রতিফলিত—যেখানে বাংলাদেশ একসময় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের 'হত্যাকারীদের' প্রত্যর্পণের জন্য আন্তর্জাতিক মহলে আবেদন জানিয়েছিল, যা কয়েকটি দেশ মৃত্যুদণ্ডের আশঙ্কায় ফিরিয়ে দিয়েছিল। এবার দৃশ্যপট বিপরীত।
অন্যদিকে, ভারতের অভ্যন্তরীণ রাজনীতি ও মিত্রদের প্রতি নৈতিক আনুগত্যের প্রশ্নটি দিল্লির সিদ্ধান্তকে গভীরভাবে প্রভাবিত করছে। শেখ হাসিনা বহু বছর ধরে ভারতের কৌশলগত স্বার্থ রক্ষায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছেন। এমন একজন বিশ্বস্ত মিত্রকে মৃত্যুদণ্ড কার্যকরের জন্য ফেরত পাঠানো ভারতের 'মিত্রনীতি'কে দুর্বল করবে বলে মনে করা হচ্ছে। উপরন্তু, ভারতের আইনজ্ঞরা মনে করছেন, বিচার প্রক্রিয়ার ন্যায্যতা ও অভিযুক্তের জীবন রক্ষার আন্তর্জাতিক মানদণ্ড রক্ষা করাও দিল্লির একটি কৌশলগত দায়িত্ব।
বর্তমানে পরিস্থিতি যেদিকে এগোচ্ছে, তাতে মনে হচ্ছে শেখ হাসিনা হয়তো দীর্ঘমেয়াদে ভারতে নির্বাসনেই থাকবেন। দিল্লি সম্ভবত প্রত্যর্পণের সিদ্ধান্তে কোনো তাড়াহুড়ো করবে না এবং কৌশলগতভাবে সময়ক্ষেপণ করবে। কারণ তারা চাইবে যে কোনো সিদ্ধান্ত ভারতের দীর্ঘমেয়াদি কৌশলগত স্বার্থ এবং আঞ্চলিক প্রভাব বজায় রাখার নীতির সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ হোক। শেষ পর্যন্ত, এই ঘটনা শুধু একজন সাবেক প্রধানমন্ত্রীর বিচার নয়; এটি দক্ষিণ এশিয়ার কূটনীতি, মিত্রতার মূল্য এবং রাষ্ট্রের প্রতি জনগণের আস্থার একটি গুরুত্বপূর্ণ পরীক্ষা।
