দেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় জনপদ সিলেট বর্তমানে ভূমিকম্পের অতি ঝুঁকিপূর্ণ 'রেড জোন' হিসেবে চিহ্নিত। ডাউকি ফল্টের (Daouki Fault) ওপর সরাসরি অবস্থান হওয়ায় অঞ্চলটি মারাত্মক ঝুঁকিতে রয়েছে। অথচ ঘন ঘন ভূকম্পন সত্ত্বেও এখানে আজো কোনো উচ্চ পর্যায়ের ভূমিকম্প নিরীক্ষা বা কৌশলগত প্রস্তুতি নেওয়া হয়নি। স্থানীয় জরিপে যে ভয়াবহ চিত্র উঠে এসেছে, তা চরম আতঙ্কের জন্ম দিলেও সংশ্লিষ্ট মহলের উদাসীনতা চোখে পড়ার মতো। ফলে বহুতলা ভবনে বসবাসকারী সিলেটের লাখো নাগরিক জীবনহানির আশঙ্কায় চরম উদ্বেগে দিন কাটাচ্ছেন।
বিশেষজ্ঞদের দাবি, গত দুই বছরে এই অঞ্চলে অন্তত ১৫ বারেরও বেশি ভূকম্পন রেকর্ড করা হয়েছে, যার মাত্রা ছিল ৫.৫ থেকে ৫.৯ পর্যন্ত। এই কম্পনগুলো ডাউকি ও কপিলি ফল্টকে সক্রিয় থাকার স্পষ্ট ইঙ্গিত দিচ্ছে। ১৮৯৭ সালের প্রলয়ঙ্করী ভূমিকম্প এবং ১৯৮০ সালের ঝাঁকুনি সিলেটকে ব্যাপকভাবে প্রভাবিত করেছিল। সেই ইতিহাস থাকা সত্ত্বেও, ২০২১ সালে মাত্র ২৪ ঘণ্টার ব্যবধানে সাতবার ভূমিকম্প আঘাত হানার পরও সংশ্লিষ্টদের স্থায়ী সতর্কতামূলক উদ্যোগের অভাব দৃশ্যমান।
অনুসন্ধানে জানা যায়, ২০১১ সালে সিলেট নগরীর জন্য মাস্টারপ্ল্যান প্রণয়ন করা হলেও তা কেবল ফাইলবন্দি একটি দলিল হয়ে আছে। নগরীর সিংহভাগ বহুতলা ভবনে ফায়ার সার্ভিসের বাধ্যতামূলক সনদ নেই, এমনকি খোদ সিটি কর্পোরেশনের প্রধান দপ্তর ভবনেও এই সনদ অনুপস্থিত। পুর ও প্রকৌশল বিভাগের বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ড. মুশতাক আহমদ জানান, ২০২১ সালে দ্রুত একটি ঝুঁকিপূর্ণ ভবনের জরিপ ও বাজেট প্রস্তাব করা হলেও তা এখনো কার্যকর হয়নি। তিনি সিলেটে একটি জরুরি ভূমিকম্প সতর্কীকরণ কেন্দ্র স্থাপনের দাবি জানান।
এদিকে, সিটি কর্পোরেশন কর্তৃপক্ষ অর্থাভাবে ভবন পরীক্ষা সম্পন্ন করতে না পারার অজুহাত দেখাচ্ছে। ২০২১ সালে ২৫টি অধিক ঝুঁকিপূর্ণ ভবনের তালিকা প্রকাশ করে সাতটি বিপণিবিতান বন্ধের নির্দেশ দেওয়া হলেও, বর্তমানে সেগুলোর অবস্থা আরও জমজমাট এবং কেবল রঙ করে চলছে হরদম। ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সের উপপরিচালক মো. শফিকুল ইসলাম সরু রাস্তা ও অপরিকল্পিত ভবন নির্মাণকে উদ্ধার অভিযানের ক্ষেত্রে বড় বাধা হিসেবে উল্লেখ করেছেন। তার মতে, সবাই শুধু বাণিজ্য নিয়েই ব্যস্ত, ঝুঁকির দিকে কারও নজর নেই।
বিশেষজ্ঞদের কঠোর হুঁশিয়ারি হলো, ঘন ঘন মৃদু কম্পনগুলো আসলে বড় ধরনের ভূমিকম্পের পূর্বাভাস। তাদের গবেষণা অনুযায়ী, ৭ মাত্রার একটি ভূমিকম্প আঘাত হানলে সিলেটের ৮০ শতাংশ বহুতলা ভবন সম্পূর্ণ ভেঙে পড়তে পারে। যুক্তরাষ্ট্রের কলম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয় ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণা মতে, অভ্যন্তরে ১৩টি ভূগর্ভস্থ চ্যুতির অবস্থান থাকায় সিলেট ও পার্বত্য চট্টগ্রামে মাঝারি থেকে তীব্র ভূমিকম্প হলে তার ব্যাপক প্রভাব ঢাকায়ও পড়তে পারে। এই প্রেক্ষাপটে, ভূমিকম্প মোকাবিলায় ডেঞ্জার জোন সিলেট কতটা প্রস্তুত, সেই মৌলিক প্রশ্নটিই এখন সব মহলে ঘুরপাক খাচ্ছে।
