দীর্ঘদিনের প্রথা ভেঙে, বাংলাদেশের রাষ্ট্রপ্রধান মো. সাহাবুদ্দিন আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পরপরই মেয়াদের মাঝপথে পদত্যাগ করার পরিকল্পনা করছেন। বৃহস্পতিবার (১১ ডিসেম্বর) ব্রিটিশ বার্তা সংস্থা রয়টার্সকে দেওয়া এক বিশেষ সাক্ষাৎকারে তিনি এই তথ্য জানিয়েছেন। সাক্ষাৎকারে তিনি স্পষ্ট করে বলেছেন, নোবেলজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের কার্যক্রমে তিনি নিজেকে 'অপমানিত' এবং 'কোণঠাসা' বোধ করছেন।
রয়টার্স উল্লেখ করেছে, বাংলাদেশের রাষ্ট্রপ্রধান হিসেবে মো. সাহাবুদ্দিন দেশের সশস্ত্র বাহিনীর সর্বাধিনায়ক হলেও, তার পদটি মূলত আনুষ্ঠানিক। ১৭ কোটি ৩০ লাখ মানুষের এই দেশে নির্বাহী ক্ষমতা থাকে প্রধানমন্ত্রী ও মন্ত্রিসভার হাতে। তবে গত বছরের আগস্টে ছাত্রনেতৃত্বাধীন আন্দোলনের মুখে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দেশত্যাগ করলে রাষ্ট্রপতির সাংবিধানিক ভূমিকা আরও গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে। সংসদ ভেঙে যাওয়ার পর তিনিই দেশের সর্বশেষ সাংবিধানিক কর্তৃপক্ষ হিসেবে গণ্য হন।
২০২৩ সালে আওয়ামী লীগের মনোনীত প্রার্থী হিসেবে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় পাঁচ বছর মেয়াদে রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হন মো. সাহাবুদ্দিন। ক্ষমতা গ্রহণের পর এটিই কোনো গণমাধ্যমকে দেওয়া তার প্রথম সাক্ষাৎকার বলে রয়টার্সকে জানান তিনি। ঢাকার সরকারি বাসভবন থেকে হোয়াটসঅ্যাপের মাধ্যমে দেওয়া সাক্ষাৎকারে ৭৫ বছর বয়সী সাহাবুদ্দিন বলেন, "আমি চলে যেতে আগ্রহী। আমি চলে যেতে চাই।"
তিনি আরও অভিযোগ করেন যে, প্রায় সাত মাস ধরে প্রধান উপদেষ্টা ড. ইউনূস তার সঙ্গে সাক্ষাৎ করেননি। তার প্রেস বিভাগকে প্রত্যাহার করে নেওয়া হয়েছে এবং সবচেয়ে অপমানের বিষয় হলো—গত সেপ্টেম্বরে বিশ্বের সব বাংলাদেশি দূতাবাস ও হাইকমিশন থেকে রাষ্ট্রপতির প্রতিকৃতি সরিয়ে ফেলা হয়েছে।
রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিন তার অপমানের মূল কারণ হিসেবে প্রতিকৃতি অপসারণের ঘটনাটিকে চিহ্নিত করেছেন। তিনি রয়টার্সকে বলেন, "সব কনস্যুলেট, দূতাবাস ও হাইকমিশনে রাষ্ট্রপতির প্রতিকৃতি থাকত। আর এগুলো এক রাতে হঠাৎ সরিয়ে ফেলা হয়েছে। এতে ভুল বার্তা যায় যে, হয়তো রাষ্ট্রপতিকে সরিয়ে দেওয়া হবে। আমি অত্যন্ত অপমানিত বোধ করেছি।
এই প্রতিকৃতি অপসারণ নিয়ে তিনি প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসকে চিঠিও লিখেছিলেন, কিন্তু কোনো পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি বলে জানান রাষ্ট্রপতি। রয়টার্স ড. ইউনূসের প্রেস-উপদেষ্টাদের কাছে এ বিষয়ে মন্তব্য চাইলেও তাৎক্ষণিকভাবে কোনো সাড়া মেলেনি।
রাষ্ট্রপতি তার সাংবিধানিক অবস্থান বজায় রেখে কাজ করার কথা জানিয়ে বলেন, "নির্বাচন না হওয়া পর্যন্ত আমার দায়িত্ব পালন করতে হবে। সাংবিধানিকভাবে রাষ্ট্রপতি পদের কারণে আমি আমার অবস্থান অক্ষুণ্ণ রাখছি।
তিনি আরও নিশ্চিত করেন যে, তিনি সেনাপ্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামানের সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ রাখছেন। ২০২৪ সালের আগস্টে হাসিনাবিরোধী প্রাণঘাতী বিক্ষোভের সময় সেনা সদস্যদের হস্তক্ষেপ না করায় প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতা ধরে রাখা অসম্ভব হয়ে পড়েছিল। মো. সাহাবুদ্দিন বলেন, জেনারেল জামান স্পষ্টভাবে জানিয়েছেন যে, তার ক্ষমতা দখলের কোনো ইচ্ছা নেই এবং তিনি গণতন্ত্রের পুনঃপ্রতিষ্ঠা চান।
যদিও বাংলাদেশে সামরিক শাসনের দীর্ঘ ইতিহাস রয়েছে, তবুও জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামান গণতন্ত্রের প্রতি তার আস্থার কথা বলেছেন। রাষ্ট্রপতি জানান, শুরুতে কিছু আন্দোলনকারী ছাত্র তার পদত্যাগ দাবি করলেও, গত কয়েক মাসে কোনো রাজনৈতিক দল তার পদত্যাগ দাবি করেনি।
জনমত জরিপ অনুযায়ী, আগামী ১২ ফেব্রুয়ারির নির্বাচনে বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামী—এই দুটি দলই পরবর্তী সরকার গঠনের ক্ষেত্রে এগিয়ে রয়েছে। এ দুটি দল ২০০১ থেকে ২০০৬ সাল পর্যন্ত জোটবদ্ধভাবে ক্ষমতায় ছিল। শেখ হাসিনা দেশ ছাড়ার পর তিনি তার সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করেছিলেন কি না—এমন প্রশ্নের জবাব দিতে অস্বীকৃতি জানান মো. সাহাবুদ্দিন। তিনি জোর দিয়ে বলেন, রাষ্ট্রপতি হওয়ার পর থেকেই তিনি স্বাধীনভাবে দায়িত্ব পালন করছেন এবং কোনো রাজনৈতিক দলের সঙ্গে তার সম্পৃক্ততা নেই।
